Monday, March 6, 2023

রুপকথার রাত

এক সময় শবে বরাত আর শবে ক্বদর ছিলো আমার জন্য খুব স্পেশাল দুটো রাত। আমি ক্যালেন্ডার ধরে এই দুই দিন মার্ক করে রাখতাম, হিসাব করতাম- কখন এই দিন আসবে।

তখন ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ি। ছোট্টো একটা শহরে থাকি। এলাকায় আমাদের একটা ছোটো গ্রুপ ছিলো। আমি, মামুন, আর মুস্তাকিম। এডভেঞ্চার টিম। মাঝে মধ্যে আমাদের সাথে যোগ দিতো মোহাম্মদ আলী আর আমিনুল। এই বন্ধুত্ব ছিলো নিখাঁদ, এর মধ্যে কোনো স্বার্থ ছিলো না, দেনা-পাওনা ছিলো না, আড্ডার কোনো স্পেসিফিক টপিক ছিলো না, তবে আড্ডা দিলে সময় ফুরাতো আলোর বেগে।
শবে বরাত আর শবে ক্বদরের রাতে অনেক জমজমাট থাকতো পুরো শহর, ইশার নামাজ শেষে ইসলামবাগ মসজিদের ইমাম সাহেব একটা বয়ান দিতেন, আমরা মনোযোগ দিয়ে বয়ান শুনতাম, তারপর মিষ্টি কিংবা জিলাপী বিতরন। আমি একটা জিলিপী খেয়ে বাকিটা রেখে দিতাম আম্মু কিংবা আপুকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য।
তারপর ইমাম সাহেব সবাইকে নিয়ে যেতেন কেন্দ্রীয় কবরস্থানে কবর জিয়ারতের জন্যে। কবরস্থান এমনিতেই অনেক ভয়ের জায়গা, কিন্তু ঐসময় একটুও ভয় লাগতো না! তারপর বন্ধুদের সাথে শহরের মসজিদে মসজিদে ঘোরা আর নামাজ পড়া।
আমরা নামাজ খুব স্পিডে পরতাম, একজন আরেকজনের সাথে কম্পিটিশন করতাম। কে কতো রাকাআত নামাজ পরতে পারে। কারও সাথে দেখা হলেই বলতো - কতো রাকাত পরলি? সত্যি বলতে কখনো হিসেবও ভুলে যেতাম, আন্দাজে একটা বলে দিতাম।
নামাজ পরে ক্লান্ত হয়ে গেলে অন্য মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা হতাম। সেখানে গিয়ে হয়তো নতুন বন্ধুদের সাথে পরিচয় হতো, আড্ডা হতো, খানিকটা ইবাদতও হতো।
তারপর ক্লান্ত হয়ে গেলে রাত ২/৩ টায় একসময় মসজিদেই ঘুমিয়ে যেতাম আমরা। ঘুম ভাঙতো ফজরের আজানে।
এই রাত দুইটা ছিলো অনেক সেলিব্রেশনের, কারন এই রাতে সব পড়াশুনা মাফ, পরের দিন স্কুল বন্ধ, সবথেকে বড় কথা এই রাতে আড্ডা দিলে আব্বু-আম্মু বাসায় মাইন্ড করতো না। কেনো জানি কিছু বলতোও না।
তারপর আস্তে আস্তে বড় হয়ে যাই, বাসা ছেড়ে মেসে থাকা শুরু করি, স্কুল পেরিয়ে কলেজ, কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটি, দেশ পেরিয়ে বিদেশ।
শবে বরাত আর শবে ক্বদর এখনো অনেক স্পেশাল রাত। সত্যি বলতে বিদেশে আসার পর আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসটা একদম কমেনি। তবে এখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছি,
এখন আর ক্যালেন্ডার ধরে হিসেব করা হয় না, হঠাৎ কারও কাছে শুনলে সারপ্রাইজড লাগে- আজকে শবে বরাত।
এখন ঐ ইনভায়রনমেন্ট আর নেই, এখন কয়েক রাকাত নামাজ পরেই গেলে ক্লান্ত হয়ে যাই, অনেক রাকাআত নামাজ পরার মোটিভেশান পাই না, নামাজ শেষে জিলাপি খাওয়া হয় না অনেকদিন, আর মসজিদ তো আশেপাশে পাওয়া দুষ্কর।
এখন আর বন্ধুদের সাথে রাত জেগে আড্ডা দেয়া হয় না, কম্পিটিশান করে নামাজ পড়া হয় না, আর ছোটোবেলার ঐ রাতগুলোকে রুপকথার রাত মনে হয়।
The grass was greener
The light was brighter
When friends surrounded
The nights of wonder
~ হাসান
সিডনী, অস্ট্রেলিয়া
০৭.০৩.২০২৩