মাঝেমধ্যেই আমি উদ্ভট কিছু স্বপ্ন দেখি। তবে আজকের স্বপ্নটা একটু ব্যতিক্রম। আমি ব্রিসবেন রিভারসাইডে বসে আছি। আমার পাশে কবি মাইকেল। মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ক্লাস টেনে যার কবিতা পড়ে বাংলাতে পাশ করেছি। মাইকেল আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন- বৎস, আমি যখন ফ্রান্সে ছিলাম, একসময় চরম হোমসিকনেসে ভোগা শুরু করি। তখন একসময় ভার্সাই শহরে বসে একটা কবিতা লিখেছিলাম- ‘কপোতাক্ষ নদ’। পরে সেটা প্রকাশিত হয়-‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ কাব্যগ্রন্থে। আমি বিড়বিড় করে পড়লাম- “সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে; সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে…”।
মাইকেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন- অনেকদিন হলো তুমি এখন প্রবাসে। মাঝেমধ্যেই বিষাদগ্রস্ত হয়ে পরো। তার উপর এখন কোয়ারেন্টিন চলছে। এটা কবিতা লিখার পারফেক্ট টাইমিং। তোমাকে আমি সাজেস্ট করবো একটা সনেট কবিতা লিখতে। কবিতার নাম হবে ‘ঘাঘট নদী’। কবিতা লিখলে বিষাদগ্রস্ততা একটুখানি হলেও প্রশমিত হবে।
আমি বললাম- ওরে বাবা। সনেট লিখা কি ছেলেখেলা কথা। চৌদ্দটা লাইন থাকতে হবে কবিতায়, আবার প্রতিটি লাইনে মোট চৌদ্দটা করে অক্ষর। সারাদিন প্রচুর ঝামেলায় থাকি জনাব- রিসার্স, স্টাডি, রান্না-বান্না, আর এখন আপনি বলছেন সনেট লিখতে। মাইকেল এবার একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন- আচ্ছা, তুমি বুকে হাত দিয়ে বল তো, এই নদীটাকে তুমি মিস কর না। আমি সাফ জবাব দিয়ে বললাম- না জনাব। আর আমি আপনার সাথে একমত না। বিশেষ করে ওই দুই লাইন- “বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে, কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে”। আমার কাছে পৃথিবীর সব নদীই একরকম। হয়তো একেক নদীর উৎপত্তি এক এক জায়গায়, কিন্তু দিনশেষে সবার গন্তব্য একটাই। সমুদ্র। সবাই একজায়গায় মিশে যায়। মাইকেল আরেকবার হাসি দিয়ে বললেন- বাছা, তুমি আমার কবিতাটা পড়ে বাংলায় এ প্লাস পেয়েছ ঠিকই, কিন্তু অনুধাবন করতে পারনি।
তারপর স্বপ্নটা ভেঙ্গে যায় আমার। ঘুম থেকে উঠে আজ চরম বিষণ্ণ হয়ে যাই আমি। পৃথিবীজুড়ে দুঃসময় চলছে। ইউরোপ আমারিকার রাস্তায় রাস্তায় লাশের মিছিল। এদিকে বাংলাদেশ নিয়ে দুশ্চিন্তা। সারা অস্ট্রেলিয়া লক ডাউন। লাস্ট কবে ব্রিসবেন রিভারসাইডে গিয়েছি মনে নেই। মন খারাপ থাকলে প্রায়ই ওখানে যেতাম আমি। বিশেষ করে সন্ধ্যার সময়। বসে পরতাম আমার ফেভারেট স্পটে। এখন ওখানটায়ও যেতে মানা। বিনা কারণে বাসার বাইরে বের হলে ১৩০০ ডলার জরিমানা গুনতে হবে।
বিদেশের নদী আসলেই একটু অন্যরকম। ব্রিসবেন রিভারের উপর দিয়ে চলে গেছে গুডউইল ব্রিজ। আর রিভারসাইডে গড়ে উঠেছে অসংখ্য হাই রাইজ বিল্ডিং। বিল্ডিং আর ব্রিজ এর চোখ ধাঁধানো আলোর প্রতিফলন নদীর পানির উপরে এক অপরূপ আলোকচ্ছটা তৈরি করে। আমি অনেকটা সম্মোহিত হয়ে যাই। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। হোমসিকনেস আর বিষাদগ্রস্তটা নিমিষেই চলে যায়।
কিন্তু তারপরও ঘাঘট নদী কেনো? এতদিনে নদীতো আর কম দেখিনি। ছোটবেলায় থাকতাম পঞ্চগড়ে। সেখানে মাঝেমধ্যেই প্রাইভেট ফাঁকি দিয়ে বন্ধুরা মিলে চলে যেতাম করতোয়া নদীতে। কতবার যে সাঁতার শিখতে গিয়ে নদীর পানি খেয়েছি, তার হিসেব নেই। তারপর গেলাম খুলনায় পড়াশুনা করতে। আমাদের কুয়েটের পাশেই ছিল ভৈরব নদী। বোরিং ক্লাস, পরীক্ষা শেষে নদীর পাশে গিয়ে বসলেই চলে যেত সব অবসাদ। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়য়ে শিক্ষকতার জন্য থাকতে হল নাটোরেরে কাদিরাবাদে। আর্মি ইউনিভার্সিটিতে। ওখান থেকেই একটু দূরে বড়াল নদী। বোরিং ফিল হলেই উইকেন্ড-এ চলে যেতাম ছাত্রদের সাথে। মাঝেমধ্যে আমার কুয়েটের জুনিয়র তাপস ফোন দিয়ে বলতো- ভাই আজকে আকাশ অনেক পরিষ্কার। চলেন ব্রিজ এ দাঁড়িয়ে তারা দেখব। আমি বাইক নিয়ে আসতেছি। ও বড়াল ব্রিজ এর উপর বাইক রেখে অনেকটা কবির মতো ভাব নিয়ে বলত- ভাই, আজ অনেকদিন পর আকাশের তারা দেখছি। আরেকবার সুযোগ পেলে আমি ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং না পরে অ্যাস্ট্রোনোমি পরতাম। মাঝেমধ্যে ও নদীর পানিতেও আকাশের তারার আলোর প্রতিফলন খুঁজতো।
তারপরও এতো নদী থাকতে ঘাঘট কেনো? যতদূর মনে পরে, ঘাঘটে লাস্ট গিয়েছি আজ প্রায় চার বছর হলো। তাও গিয়েছি মোটে মাত্র একবার। রংপুর ক্যান্টনমেন্ট এর পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা একটা নদী। নদীর ওপারে কাশবন আর ঝাউবন। নৌকা দিয়ে পার হয়ে যেতে হয় এপার থেকে ওপারে। ওইদিন নদীর পারে বসে ছিলাম অনেকক্ষণ। চারদিকে শুনশান নীরবতা। নদীর পানির শব্দ আছড়ে পরছে ঘাটে, আর এক অপরূপ ছন্দ তৈরি করছে। কে জানতো, সেই সময় এক অজানা মায়াজালে বাঁধিয়ে ফেলবে এ নদী। এরপর যত নদীতেই গিয়েছি, কোনোটাই ঘাঘটের মতো মনে হয় নি। হয়তোবা হবেও না।
বাংলাদেশ ছেড়েছি প্রায় দেড় বছর হলো। অস্ট্রেলিয়া আসার পর প্রায়ই রাতে ঘুম আসতে চায় না আমার। তখন আমি চোখ বন্ধ করে একটা নদীর কথা ভাবি। ছোট্ট আঁকাবাঁকা একটা নদী। নদীর ওপারে কাশবন। আমি এপারে বসে একা। কি মায়াবতী নদী! দূর থেকে নদীর পানির কলকল শব্দ। সেই শব্দ আমাকে সম্মোহিত করে দেয়। আমার ঘুম এসে যায়।
হয়তো আমার কল্পনার ওই মায়াবতী নদীটাই-‘ঘাঘট’। ঘাঘট নদী রংপুর শহর থেকে খুব বেশি দূরে নয়। আমি রংপুরের ছেলে। তবুও বাসায় থাকতে কখনো এই নদীর প্রতি এতোটা টান অনুভব করিনি কখনো। হয়তো বন্ধুরা যাবার কথা বললে ব্যস্ততার ছলে কাটিয়ে দিয়েছি। আজ কেনো জানি খুব ইচ্ছে হচ্ছে ঘাঘটের পাড়ে গিয়ে বসি। হয়তো কোনো কবিতা রচনা করা হবে না। তারপরও।
মাইকেলের সাথে আমার আর কখনো দেখা হবে কিনা জানি না। দেখা হলে ওনাকে একটা কথা বলবো। স্যার, আপনার কথাটা আমি রাখতে পারিনি। আমি আপনার মতো প্রতিভাবান নই, তাই হয়তো ঘাঘট
নিয়ে সনেট লিখা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। তবে আমি একটা গল্প লিখেছি। নাম শুনবেন স্যার? নদীর নাম মায়াবতী ।
নিয়ে সনেট লিখা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। তবে আমি একটা গল্প লিখেছি। নাম শুনবেন স্যার? নদীর নাম মায়াবতী ।
মুবিন হাসান
পোস্টগ্রাজুয়েট স্কলার, কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলোজি
ব্রিসবেন, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া
পোস্টগ্রাজুয়েট স্কলার, কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলোজি
ব্রিসবেন, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া
No comments:
Post a Comment