ছোট বেলায় আমি বেশ ফাঁকিবাজ ছিলাম।
আমার বড় ভাই নেই। বড় আপুরা বরাবরই আমার চেয়ে অনেক ভাল
স্টুডেন্ট ছিল।
তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। বাসায় কোনো গেস্ট আসলেই আব্বু
রীতিমতো আপুদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকতো। আমি প্রায়ই আব্বুকে বলতে শুনতাম….
“আমার বড় মেয়ে ক্লাস ফাইভে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি, ক্লাস এইটে ট্যালেন্টপুলে
বৃত্তি, ম্যাট্রিকে বোর্ড বৃত্তি…………..আর ছোট মেয়েও ক্লাস ফাইভে, এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি এইবার
ক্লাস নাইনে গভঃ গার্লস এ সেকেন্ড গার্ল………….. ইত্যাদি
ইত্যাদি”
তবে আমার কথা আসলেই বিপদ ছিল- কারন আমি পড়াশুনা করতে চাই
না। পড়ার কথা বললে নাকি আমার মাথা ব্যাথা শুরু হয়….. ইত্যাদি ইত্যাদি ।
এক সময় আমাকে হুমকি দেয়া হল- ফাইভে বৃত্তি না পেলে আবার ক্লাস ফাইভে থাকতে হবে।
কয়েকদিন পরে শাস্তির মাত্রা আরও বেড়ে গেল… এবার
আমাকে হুমকি দেয়া হল- ফাইভে বৃত্তি না পেলে আব্বু নাকি আমাকে মাদ্রাসায় ভর্তি
করিয়ে দেবে… আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম। ঘুমে ঢুলু ঢুলু
চোখ নিয়ে রাত ১০/১১ টা পর্যন্ত পড়তাম। ঝিমুনি ধরলে ফাঁকি দেবার উপায় নেই... কারন
পেছনে আব্বু পজিশন নিয়ে বসে আছে। ঝিমুনি আসলেই –“চোখে পানি দিয়া আবার পড়তে বস।”
যাই হোক তারই জের ধরে আমাকে প্রতিদিনই আম্মুর গালি খেতে
হত। আম্মু প্রায়ই বলত “পড়াশুনা না করলে বড় হয়ে বোনের পিছে পিছে হ্যান্ডব্যাগ নিয়া
বেড়াতে হবে।”
হয়তোবা সে জন্যই আমার মাথায় একটা ছবি ভেসে উঠত- এখনও
ওঠে- বড় আপু সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আর আমি পেছন পেছন ব্যাগ হাতে হাঁটছি।
ব্যাপারটা ভাবতেই আমার কাছে বেশ ভাল লাগতো- কেন জানি না।
বড় আপুরা আমার কাছে অনেকটা আদর্শের মতই ছিল। যাকে বলে sample অথবা ideal অথবা nominal. ক্লাস সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত প্রায় সব
হ্যান্ডনোটই তৈরি ছিল- আমি শুধু গলাধঃকরনের কাজটা করতাম। আব্বু-আম্মুর আশা খানিকটা
হলেও পূরণ করতে পেরেছিলাম... ফাইভ আর এইটে বৃত্তিও পেয়েছিলাম... SSC আর HSC র রেজাল্টটা এত বেশি ভাল হবে স্বপ্নেও
ভাবতে পারি নি... অবশ্যই আল্লাহ্র সাহায্য ছাড়া তা অসম্ভব ছিল।
এখন বড় আপু ডাক্তার। ছোট আপুও ভাল একটা
পজিশন এ। আপুদের পরপর বিয়ে হয়ে গেলো। বাসা ফাঁকা হতে শুরু করেছে। আগে আমরা একসাথে
ঈদ করতাম। এখন আপুরা করে শ্বশুরবাড়িতে।
বরাবরের মত আব্বু-আম্মু
আর আপুদের inspiration এর এখনো একটুও কমতি নেই... যখনই পা ফসকে
লাইনচ্যুত হয়ে গিয়েছি, তখনই তারা আমাকে হাত ধরে লাইনটা দেখিয়ে দিয়েছে। বন্ধুদের প্রায়ই বলি ... ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে
বের হয়ে চাকরি না পেলে আপুর চেম্বারেই কম্পাউন্ডার হিসেবেই চাকরিটা শুরু করবো...
যদিও ব্যাপারটা হাস্যকর ও অসম্ভব।
সেই ছবিটা এখনো ভেসে উঠছে- বড় আপু সামনে দিয়ে হেঁটে
যাচ্ছে আর আমি পেছন পেছন ব্যাগ হাতে হাঁটছি... হাঁটতে হাঁটতে আমরা গল্প
করছি... আমাদের রাস্তা শেষ হচ্ছে না...
গল্পও শেষ হচ্ছে না... আপু হাসছে... আমিও হাসছি...
(আল্লাহ্ তুমি আমাদের
ভাই-বোনের এই মধুর সম্পর্কটা মৃত্যু পর্যন্ত ভাল রাখিও। আমিন।)
No comments:
Post a Comment