এখানে আসার কোনো ধরনের ইচ্ছাই ছিল না আমার।
আই ইউ টি- তে চান্স হয়েছে। Scholarship সহ। লিভিং, টিউশন ফি মিলে সাড়ে চার লাখ টাকা। আব্বু বললো- যাও, IUT তে ভর্তি হও। বড় আপুরও ইচ্ছা আমি ওইখানে ভর্তি হই। বড়আপু বলল- যাও ক্যাম্পাস গিয়া Decision নাও।
আমি উভয় সংকটে পড়লাম। Horns of a dilemma. জামাল ভাই আমারে IUT’ র ক্যাম্পাসে নিয়ে গেলেন। রেজিস্ট্রার স্যারের সাথে কথা হলো অনেকক্ষণ। জামাল ভাই স্বাধীনচেতা মানুষ। বললো দেখো কি করবা..
Decision making এ আমি বরাবর-ই কাঁচা। IUT'র ক্যাম্পাসে বইসা আমি চিন্তা করতেছি Dhaka University CSE তে পড়লে কেমন হয়? TSC’ র লাইফ জীবনেও পামু না গাজীপুর থাইকা। আব্বুকে ফোন দিলাম। বললাম, ছোটো থেকে তুমি যাই কিনে দিছো, তাই নিছি। জীবনে একটা T-shirt ও নিজে কিনি নাই। তুমি যেইখানে বলবা সেখানে ভর্তি হবো।
আমার আব্বু চালাক মানুষ। জীবনের প্রথম এই একটা Decision আমার নিজের হাতে ছেড়ে দিলো। বললো, পরে পড়তে ভাল্লাগবে না আর আমার দোষ দিবা-তা হবে না। DU, KUET, RUET ,IUT যেখানে ইচ্ছা ভর্তি হও। বুঝলাম বাপের আক্ষেপটা তখনও মেডিকেল কোচিং করি নাই কেন- এইটা নিয়া। আমি জামাল ভাইরে বললাম ঢাকা ভার্সিটি চলেন। উনি বললো-চলো।
আমি বইসা আছি টি এস সি'র বটতলায়। চিন্তা করতেছি আমার ভবিষ্যত নিয়ে। অপশন এখন তিনটা। DU CSE, KUET EEE, RUET EEE. কলেজ ফ্রেন্ড সাইদরে ফোন দিলাম। বললাম- তুমি যেইখানে ভর্তি হবা আমিও ওইখানে- এইটাই ফাইনাল। এই জায়গায় বইসাই লাস্ট Decision ফাইনাল করলাম। Decision ফাইনাল। কুয়েট। যা আছে জীবনে। যা যাবে দুইজনের উপর দিয়াই যাবে। জীবনের নতুন একটা অধ্যায়। কুয়েট অধ্যায়ের শুরু।
কুয়েটে প্রথমের দিনগুলা খুব খারাপ যেত আমার। ঢাকার মায়াটা কিছুতেই ত্যাগ করতে পারতেছিলাম না। ক্লাস টেস্ট এর মার্কস গুলাও খুব একটা ভালো আসতো না আমার। সাইদরে মাঝে মধ্যেই বলতাম পড়াশুনা বাদ দিবো। আমার দ্বারা যাই হোক ইঞ্জিনিয়ারিং হবে না। ফার্স্ট CT তে কুপোকাত হয়ে গেলাম। মার্কস কম। অনেক কম। এই মার্ক দিয়া কি করবা! চাকরি পাবা না.. সার্টিফিকেট হাতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হবে! Solution একটাই। বিড়ি খাইতে হবে। টেনশন কমবে। Creativity বাড়বে। বিড়ি খাইতে গেলাম। সাথে ছিল আশিক। গোল্ড লিফ সিগারেট কিনলাম। ভাগ্যিস বিড়ি আমার কাছে হার মানলো! বিড়ি খাইতে গিয়া দ্বিগুণ পরিমাণ হতাশ হলাম। শেষমেশ একটা টানও দিতে পারলাম না!
হতাশা কাটানোর জন্য বাসায় না জানিয়েই টিউশনি ধরলাম। সমস্যা একটাই- পরীক্ষার আগে চাপ বেশি থাকতো। মাথায় একটা করে ভূত চাপতো, আর একটা করে টিউশানি ছাড়তাম। আতিক, সাইদ, সৌমিত্র দের সাথে ভালই কাটছিল ব্যাস্ত দিনগুলি। মাঝে মধ্যে হয়তো ব্যাস্ত থাকাটা আমাদের নিজের ভালোর জন্যই জরুরী। আমাদের আড্ডা চলতো রাত ২-৩ টা পর্যন্ত। সাইদ মাঝে মধ্যে জ্ঞান দিতো আমাদের। আতিকের সাথে মাঝে মধ্যে তর্ক লাগতো নানা বিষয় নিয়ে। দুইদিন পর আবার সব কিছু ঠিক। আর সেমিস্টার ফাইনাল শেষে সৌমিত্রের সাথে শুরু হতো আমাদের অ্যাডভেঞ্চার...
একসময় খুব ভালো লেগে গেলো সাজানো- গুছানো এই শহরটাকে। খুলনার প্রায় সব জায়গাই আমার চেনা। মাঝে মধ্যে একা একা ঘুরতে বের হতাম আমি। অচেনা রাস্তা ধরে যাবার মধ্যে অন্য একধরণের মজা আছে। টিউশনির ছলেও কম ঘুরা হতো না! সময়গুলাও খুব একটা খারাপ যেত না। সমস্যাটা হতো সেমিস্টার ফাইনাল আসলে। মাথায় ভুত চাপতো। ছলচাতুরী দিয়ে ছেড়ে দিতাম টিউশনিগুলো। হয়তো স্টুডেন্টরা মন খারাপ করতো। হয়তোবা মনে মনে বকা দিতো!! বাসা থেকে বের হয়ে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যেতো আমার। আমার মনের অবস্থাটা না বলাই থেকে যেতো..
মনে থাকবে খালিশপুর থানা রোডের দোতলা ওই বাড়িটার কথা। অথবা বাড়ির সামনের ওই বকুল গাছটার কথা। বকুল ফুলগুলোর দিকে খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকিয়ে থাকতাম আমি। আচ্ছা, এখনো কি ঐ গাছটায় ফুল ফোটে? মনে থাকবে সিলিং ফ্যানের বাতাসে ভেসে যাওয়া উদ্ভট,অবান্তর ও অযৌক্তিক কিছু প্রশ্ন। মনে থাকবে সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড, সারজিকাল মোড় অথবা মুজগুন্নির ওই মেলার মাঠের কথা। মাঠের কুকুরগুলোর ঘেউ ঘেউ খুব ভয় পেতাম আমি। মেগার বিরিয়ানি হাউসের বিরিয়ানিটার স্বাদটাও কখনো ভুলবার মত নয়।
মনে থাকবে রেল লাইনের পাশ দিয়ে একা একা হেঁটে যাওয়া, রাত জেগে মুভি- সিরিয়াল দেখা, বৃষ্টির দিনে ন্যান্সির ওই গানটা... অথবা লাউডস্পিকারে Tailor Swift এর You belong with me গানের গগনবিদারী চিৎকার। মনে থাকবে Feast এর সেই দিনগুলোর কথা। বিকালবেলা না খেয়ে থাকতাম আমরা- রাতে খাবো বলে। মনে থাকবে ফ্রেন্ড দের Birthday তে ঘাপিয়ে দেবার কথা। মনে থাকবে খোলা আকাশের নীচে চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে গান গাওয়া। মনে থাকবে ওই সময়টার কথা যখন মাঝে মধ্যেই মনে হতো- “Life is beautiful...”
আমরা স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি। উদ্ভট , অবান্তর আর অযৌক্তিক কিছু স্বপ্ন। কিছু স্বপ্ন কখনোই পূরণ হয় না। দূর থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে, কিন্তু কখনোই কাছে এসে ধরা দিতে চায় না। স্বপ্নগুলো স্বপ্ন হয়েই রয়ে যায়। শুধু একটি দাগ কেটে যায় স্মৃতির পাতায়।
কুয়েট আমাকে অনেক স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে এর চেয়েও বেশি কিছু স্বপ্ন। তারপর আবারও নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। 4 out of 4 পাওয়ার স্বপ্নটা কখনোই পূরণ হবার নয়। আমার দৌড় 3.96 পর্যন্ত। হয়তোবা আমি অতটার যোগ্য নই।
ছেড়ে গেলাম খুলনা শহর, পেছনে থেকে গেল ভালো লাগা, না লাগা অনেকগুলো স্মৃতি। থাক না স্মৃতিগুলো স্মৃতি হয়ে, থাক না কিছু স্বপ্ন স্বপ্ন হয়ে। উদ্ভট , অবান্তর স্বপ্ন। crazy, stupid dream...
ভালো থাকুক খুলনা শহর। ভালো থাকুক খুলনা শহরের মানুষগুলো। ভালো থাকুক কুয়েট পরিবার। বেঁচে থাকলে হয়তোবা আবার দেখা হবে। কোনো বৃষ্টির দিনে, অথবা কোন জোৎসনাস্নাত রাতে। কুয়েট ক্যাম্পাসে, পদ্মপুকুরে, জিরো পয়েন্টে, বেজেরডাঙ্গায় অথবা মেগার মোড়ে।
সো নেভার টু লুস হোপ, নেভার টু সে গুড বাই...
No comments:
Post a Comment